প্রকৃতির মাঝে স্রষ্টাকে খুঁজে পাওয়া
প্রকৃতির মাঝে স্রষ্টাকে খুঁজে পাওয়া
এই বিশাল পৃথিবী, আকাশ, সূর্য, চাঁদ, তারকা, গাছপালা, পর্বত ও নদ-নদী—সবকিছু যেন একসাথে উচ্চারণ করছে একটাই সত্য: “একজন মহান স্রষ্টা আছেন, যিনি এই মহাবিশ্বের প্রতিটি কণা নিপুণভাবে সৃষ্টি করেছেন।” প্রকৃতির প্রতিটি দিকেই রয়েছে তাঁর ক্ষমতা, হিকমত ও করুণার অনুপম প্রকাশ। মানুষের যদি হৃদয় থাকে, সে প্রকৃতির প্রতিটি দৃশ্যেই তার রবের উপস্থিতি অনুভব করতে পারে।
যখন সকালের আলো ভোরের দিগন্তে ছড়িয়ে পড়ে, পাখিরা আল্লাহর প্রশংসায় গাইতে শুরু করে, শিশিরে ভেজা পাতায় সূর্যের রশ্মি ঝিলমিল করে—তখন প্রতিটি জিনিস ঘোষণা করে, “আল্লাহু আকবার!” এই নিসর্গ, এই বাতাস, এই আলোর স্রোত যেন সাক্ষ্য দিচ্ছে: “যিনি এগুলোকে সৃষ্টি করেছেন, তিনি পরম করুণাময়, তিনি এক ও অদ্বিতীয়।”
﴿إِنَّ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاخْتِلَافِ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ لَآيَاتٍ لِّأُولِي الْأَلْبَابِ﴾
“নিশ্চয়ই আসমানসমূহ ও জমিনের সৃষ্টি এবং রাত ও দিনের পরিবর্তনে বুদ্ধিমানদের জন্য নিদর্শন রয়েছে।”
— (সূরা আলে ইমরান, ৩:১৯০)
এই আয়াত মানুষকে চিন্তা করতে আহ্বান জানায়। আসমান ও জমিনের এই নিখুঁত বিন্যাস, সূর্যের নির্দিষ্ট কক্ষপথ, চাঁদের উজ্জ্বলতা, ঋতুর পরিবর্তন—সবকিছুই এক নির্ভুল নিয়মে চলছে। কে নির্ধারণ করল এই নিয়ম? কে সূর্যকে নির্দিষ্ট সময়ে উঠতে ও অস্ত যেতে বাধ্য করল? কে সাগরের ঢেউকে সীমারেখার বাইরে যেতে দেয় না?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর একটাই— “আল্লাহ তাআলা।” তিনিই সবকিছুর স্রষ্টা, পালনকর্তা ও নিয়ন্ত্রক। পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণ, প্রতিটি বৃক্ষ, প্রতিটি বৃষ্টি ফোঁটা তাঁর আদেশেই জীবিত থাকে ও কাজ করে।
যখন মেঘ জমে আকাশে, বিদ্যুৎ ঝলকায়, তারপর ধীরে ধীরে বৃষ্টি নামে—তখন প্রতিটি ফোঁটা যেন বলে ওঠে, “আমি এক মহান শক্তির আদেশে নেমে এসেছি।” যখন মাটি সেই বৃষ্টিকে গ্রহণ করে, শুকনো গাছগুলো সবুজে ভরে যায়, ফুল ফোটে, ফল ধরে—তখন বোঝা যায় আল্লাহর দয়া কেমন অফুরন্ত।
﴿وَهُوَ الَّذِي يُنَزِّلُ الْغَيْثَ مِن بَعْدِ مَا قَنَطُوا وَيَنشُرُ رَحْمَتَهُ﴾
“তিনি-ই সেইজন, যিনি মানুষের নিরাশ হওয়ার পর বৃষ্টি বর্ষণ করেন এবং তাঁর দয়া বিস্তার করেন।”
— (সূরা আশ-শুরা, ৪২:২৮)
একবার গভীরভাবে ভাবো — এই পৃথিবী সূর্যের থেকে একদম নির্দিষ্ট দূরত্বে ঘুরছে। যদি একটু বেশি কাছে যেত, তবে পৃথিবী আগুনে পুড়ে যেত। আর যদি একটু দূরে সরত, তবে জমে যেত বরফে। এই নিখুঁত ভারসাম্য কে রক্ষা করছে? নিশ্চয়ই, যিনি এই সৃষ্টিকে জ্ঞান ও মাপের সঙ্গে সৃষ্টি করেছেন — আল্লাহ, রব্বুল আলামিন।
আল্লাহ তাআলা বলেন—
﴿وَخَلَقَ كُلَّ شَيْءٍ فَقَدَّرَهُ تَقْدِيرًا﴾
“তিনি সবকিছু সৃষ্টি করেছেন নির্ধারিত পরিমাপে।”
— (সূরা আল-ফুরকান, ২৫:২)
প্রকৃতির প্রতিটি দিকেই আল্লাহর পরিমাপের নিখুঁততা দেখা যায়। পাহাড়ের উচ্চতা, সমুদ্রের গভীরতা, বাতাসের প্রবাহ, এমনকি একটি মৌমাছির ডানার নাড়াও তাঁর নির্ধারিত পরিমাপে ঘটে। মানুষ শুধু তার চোখ খুলে দেখুক, হৃদয় খুলে অনুভব করুক, তাহলেই সে আল্লাহর মহান সত্তার প্রমাণ পাবে।
প্রকৃতির মাঝে স্রষ্টার উপস্থিতি শুধুমাত্র দেখা নয়, অনুভবের বিষয়। যখন রাতের আকাশে অসংখ্য তারা ঝলমল করে, চাঁদের আলো নিঃশব্দে পৃথিবীকে আলোকিত করে, তখন মনে হয়— “এ আলোকই যেন স্রষ্টার কৃপা।” রাতের নিস্তব্ধতায় হৃদয় জেগে ওঠে, মুখে আসে একটিই শব্দ— “সুবহানাল্লাহ!”
আল্লাহ তাআলা মানুষকে এই প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করতে বলেছেন, কারণ প্রকৃতির প্রতিটি অংশ মানুষকে আল্লাহর চিন্তায় নিমগ্ন করে। যিনি আকাশের তারা দিয়ে পথচলাকে সহজ করেছেন, যিনি মেঘে বৃষ্টি ভরেছেন, যিনি বাতাসকে জীবন দিয়েছেন— তিনিই মানুষকে আহ্বান করছেন যেন সে শুধু দুনিয়ার সৌন্দর্যে নয়, বরং সেই সৌন্দর্যের স্রষ্টার দিকে মন দেয়।
কুরআনে আল্লাহ বলেন—
﴿أَفَلَا يَنظُرُونَ إِلَى الْإِبِلِ كَيْفَ خُلِقَتْ وَإِلَى السَّمَاءِ كَيْفَ رُفِعَتْ وَإِلَى الْجِبَالِ كَيْفَ نُصِبَتْ وَإِلَى الْأَرْضِ كَيْفَ سُطِحَتْ﴾
“তারা কি উটের দিকে তাকায় না—কীভাবে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে? আর আকাশের দিকে—কীভাবে তা উঁচু করা হয়েছে? আর পাহাড়ের দিকে—কীভাবে তা স্থাপন করা হয়েছে? আর পৃথিবীর দিকে—কীভাবে তা বিছানো হয়েছে?”
— (সূরা আল-গাশিয়াহ, ৮৮:১৭–২০)
এই আয়াতগুলো শুধু পড়ার জন্য নয়, চিন্তা করার জন্য। আল্লাহ তাআলা আমাদের দৃষ্টি প্রকৃতির দিকে ফেরান, যাতে আমরা প্রকৃতির ভেতর দিয়ে স্রষ্টাকে চিনতে পারি। প্রকৃতিই হচ্ছে তাওহীদের এক জীবন্ত দলিল—যে যত গভীরভাবে দেখবে, ততই আল্লাহর মহত্ত্ব অনুভব করবে।
সত্যিই, যে ব্যক্তি প্রকৃতিকে ভালোবাসে, সে আল্লাহর সৃষ্টিকে ভালোবাসে। আর যে সৃষ্টিকে ভালোবাসে, সে স্রষ্টার নৈকট্য লাভ করে। কারণ এই আকাশ, এই বাতাস, এই বৃষ্টি, এই গাছের পাতার শব্দ—সবকিছুই আমাদের শেখায়, “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ।”
Comments
Post a Comment