নিরাশ হইনি আমি হে প্রভু

 

নিরাশ হইনি আমি হে প্রভু 

মুহাম্মদ মুনীরুজ্জামান ত্বলহা দ্বীনের দ্বীপ্তি 

নিরাশ হইনি আমি হে প্রভু! যতই কষ্টে থাকি, যতই বিপদের ঘূর্ণিতে আটকে যাই, তবু আমার হৃদয় কখনো আশা হারায় না। কারণ আমি জানি—তুমি আছো, তুমি শুনছো, তুমি জানো। পৃথিবীর প্রতিটি দুঃখ যেন এক অজানা বার্তা নিয়ে আসে, যেন বলে যায়: “ধৈর্য ধর, তোমার প্রভু তোমার সঙ্গে আছেন।”

জীবনের পথে অনেক বাধা এসেছে—রোগ, দারিদ্র্য, অপমান, একাকিত্ব, দুর্বলতা—সবকিছুই যেন আমাকে ভেঙে দিতে চেয়েছে। মানুষ কখনো তুচ্ছ ভেবেছে, কেউ উপহাস করেছে, কেউ দূরে সরে গেছে। কিন্তু আমি জানতাম, এক শক্তি আছে যিনি আমাকে কখনো তুচ্ছ মনে করেন না, যিনি আমার অশ্রু দেখেন, আমার নিঃশব্দ কণ্ঠ শুনে নেন—তিনি আমার প্রভু, আমার রব।

“وَلَا تَيْأَسُوا مِن رَّوْحِ اللَّهِ ۖ إِنَّهُ لَا يَيْأَسُ مِن رَّوْحِ اللَّهِ إِلَّا الْقَوْمُ الْكَافِرُونَ”
“তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহ থেকে নিরাশ হয়ো না; আল্লাহর রহমত থেকে কেবল কাফিররাই নিরাশ হয়।” (সূরা ইউসুফ, আয়াত ৮৭)

এই আয়াত আমার প্রাণে নতুন আলো ছড়ায়। যতবার হতাশা আমার বুকের ভেতর ঢুকে পড়তে চেয়েছে, ততবার আমি এই আয়াতের আলোয় নিজেকে জাগিয়েছি। কারণ আমি জানি—যে আল্লাহ মাটির কণায় প্রাণ দিয়েছেন, শুকনো গাছকে সবুজ করেছেন, অন্ধকার আকাশে তারা জ্বালিয়েছেন—তিনি তো আমার বুকের শূন্যতাকেও আলোয় ভরিয়ে দিতে পারেন।

আমি যখন দুর্বল হই, তখনও তাঁর শক্তি আমার আশ্রয়। আমি যখন নিঃস্ব হই, তখনও তাঁর রহমত আমার ধন। আমি যখন একা হই, তখনও তাঁর স্মরণে আমার মন পরিপূর্ণ হয়ে যায়। নিরাশ হইনি আমি হে প্রভু, কারণ আমি তোমার কাছে সেই অশ্রু ফেলেছি যা কোনো মানুষের কাছে বলা যায়নি। আমি তোমার কাছেই বলেছি, “হে আল্লাহ, তুমি আমার রব, আমি তোমার দাস, তুমি আমার অভিভাবক, আমি তোমার আশ্রয়ে।”

প্রতিদিনের সূর্যোদয় আমাকে শেখায়—রাত যতই অন্ধকার হোক, ভোর আসবেই। বৃষ্টির পর যেমন ফুল ফোটে, তেমনি কষ্টের পরও রহমত আসে। তোমার প্রতিটি পরীক্ষা আসলে আমার জন্যই এক প্রশিক্ষণ, যাতে আমি আরও দৃঢ় হই, আরও ঈমানদার হই। তাই আমি তোমাকে ভালোবেসে বলি—“হে প্রভু, কষ্ট দাও, কিন্তু তোমার ভালোবাসা থেকে আমাকে বিচ্ছিন্ন করো না।”

“فَإِنَّ مَعَ الْعُسْرِ يُسْرًا ۝ إِنَّ مَعَ الْعُسْرِ يُسْرًا”
“নিশ্চয়ই কষ্টের সাথেই রয়েছে স্বস্তি। হ্যাঁ, কষ্টের সাথেই রয়েছে স্বস্তি।” (সূরা আশ-শরহ, আয়াত ৫-৬)

এই আয়াতই আমার জীবনমন্ত্র। যখনই চোখে জল আসে, আমি মনে করি—এ চোখের জলই একদিন আনন্দে রূপ নেবে। যখন ব্যর্থতা আমাকে গ্রাস করতে চায়, আমি মনে করি—এ ব্যর্থতাই আমাকে সফলতার পথে প্রস্তুত করছে। যখন মানুষ আমাকে অবহেলা করে, আমি হাসি, কারণ জানি—তোমার দরবারে আমি অবহেলিত নই।

আমার দারিদ্র্য, আমার অসুখ, আমার মেধার সীমাবদ্ধতা—এসবই একেকটি আয়না, যা আমাকে নিজের অক্ষমতা ও তোমার মহত্ত্ব দেখায়। আমি বুঝি, আমি কিছুই নই, কিন্তু তোমার দয়া ছাড়া কিছুই হতে পারতাম না। পৃথিবীর মানুষ যদি আমায় ভুলে যায়, তবু আমি জানি—তুমি আমায় কখনো ভোলোনি, কখনো ভোলবে না।

রাতের শেষ প্রহরে যখন সবাই ঘুমিয়ে থাকে, আমি নিঃশব্দে তোমার সামনে দাঁড়াই। চারপাশে নীরবতা, কেবল চোখের কোণে জমে থাকা জল। আমি বলি—“হে আল্লাহ, আমি জানি না কেন তুমি আমাকে এত পরীক্ষা দাও, কিন্তু আমি জানি, তুমি ছাড়া কেউ এ পরীক্ষার ফল দিতে পারবে না।” সেই একাকিত্বের মুহূর্তেই আমি সবচেয়ে বেশি তোমার উপস্থিতি অনুভব করি।

জীবনের প্রতিটি বিপদে আমি তোমার দরবারে আশ্রয় নিয়েছি। যখন কেউ সান্ত্বনা দেয়নি, তুমি দিয়েছো। যখন দুনিয়া মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, তুমি বলেছো—“আমি তোমার জন্য যথেষ্ট।” তখন আমার বুকের ভিতর এক সান্ত্বনার বৃষ্টি নামে, যা কোনো ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।

হে প্রভু, আমি তোমার প্রেমে পড়েছি, তোমার নীরব সান্ত্বনায় আশ্রয় পেয়েছি। তুমি আমার সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা, সবচেয়ে প্রিয় স্বপ্ন। আমি জানি, তুমি আমার প্রতিটি কান্না শুনে রেখেছো, প্রতিটি দীর্ঘশ্বাসের জবাব একদিন দেবে। তাই আমি কখনো নিরাশ হইনি, হবও না। কারণ তোমার দরজা কখনো বন্ধ হয় না।

এই লেখাটি আমি লম্বা করতে চাইনি, কিন্তু অন্তরের আবেগ থামানো গেল না। কথাগুলো যেন অশ্রুর ভাষা হয়ে কলমে ঝরে পড়ল। এজন্য আমি বিশেষভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। তবে এই কথাগুলোই আমার হৃদয়ের প্রার্থনা—যে প্রভুর প্রেমে আমি কখনো নিরাশ হইনি, হব না ইনশাআল্লাহ।

— মুহাম্মদ মুনীরুজ্জামান ত্বলহা

Comments

Popular posts from this blog

“দ্বীনের দীপ্তি: ইসলামের মূল শিক্ষা”

স্মৃতির প্রাঙ্গণ ও মাধুর্যের ঋণ

📘 প্রথম সাময়িক পরীক্ষার প্রস্তুতি