তাওয়াক্কুলের আলোয় জেগে ওঠা জীবন
তাওয়াক্কুলের আলোয় জেগে ওঠা জীবন
ভরসা করেছি শুধু তোমারই ওপর, হে প্রভু। জীবনের পথে যতই ঝড় এসেছে, যতই মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, আমার হৃদয় তখনও তোমার নামেই দৃঢ় থেকেছে। কারণ আমি জানি—যে মানুষ আল্লাহর উপর নির্ভর করে, সে কখনো একা হয় না, কখনো পরাজিত হয় না।
জীবনের প্রতিটি বাঁকে আমি তাওয়াক্কুলের সৌন্দর্য দেখেছি। কখনো জীবনের দরজা বন্ধ হয়ে গেছে, তবু অন্তরে একটি আশ্বাস জেগেছে—“যিনি বন্ধ করেন, তিনিই খুলবেন।” কখনো হৃদয় ভেঙেছে, তবু মনে হয়েছে—“যিনি কষ্ট দেন, তিনিই প্রশান্তিও দেবেন।” আমি পড়েছি, শুনেছি, অনুভব করেছি—আল্লাহ সেই সত্তা যিনি বান্দার জন্য যথেষ্ট।
“যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করে, আল্লাহই তার জন্য যথেষ্ট।” (সূরা আত-তালাক, আয়াত ৩)
এই আয়াত আমার হৃদয়ে গভীর আলো জ্বালিয়েছে। আমি বুঝেছি, তাওয়াক্কুল মানে হাত গুটিয়ে বসে থাকা নয়—বরং সব চেষ্টা করে শেষে ফলের ব্যাপারে আল্লাহর উপর পূর্ণ ভরসা রাখা। আমি যখন চেষ্টা করেছি, কিন্তু ফল আসেনি, তখন আমি হতাশ হইনি। কারণ আমি জানি, ফল নির্ধারণের মালিক আমিই নই—তিনি আমার রব।
মানুষ যখন আমাকে বলেছে, “তুমি পারবে না,” তখন আমি বলেছি, “আমার প্রভু পারিয়ে দেবেন।” যখন মানুষ বলেছে, “তুমি একা,” আমি বলেছি, “আল্লাহ আমার সঙ্গী।” এই বিশ্বাসই আমাকে জীবনের প্রতিটি দুঃসময়ে টিকিয়ে রেখেছে। যতই কঠিন হোক জীবন, আমি শিখেছি—তাওয়াক্কুল মানেই আলো, যা অন্ধকারকেও আলোকিত করে।
“যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করে, সে যেন পাহাড়ের মতো দৃঢ়—বাতাসে দুলে, কিন্তু ভাঙে না।” — ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রহ.
তাওয়াক্কুল এমন এক অভ্যন্তরীণ শান্তি, যা দুনিয়ার কোনো সম্পদে পাওয়া যায় না। যে তাওয়াক্কুলের মিষ্টতা অনুভব করে, সে বিপদের মধ্যেও হাসতে পারে। কারণ সে জানে, বিপদ মানেই আল্লাহর পরীক্ষা; আর পরীক্ষা মানেই প্রিয় বান্দাদের জন্য উন্নতির সিঁড়ি।
আমি অনেকবার পড়ে গিয়েছি, অনেকবার হেরে গিয়েছি। কিন্তু প্রতিবার উঠতে পেরেছি কেবল তাওয়াক্কুলের শক্তিতে। আমি অনুভব করেছি, তাওয়াক্কুল শুধু ভাষায় উচ্চারিত বিশ্বাস নয়, বরং অন্তরের গভীরে প্রোথিত এক দৃঢ় আস্থা—যা মানুষকে অন্ধকারে আলো দেখায়।
কুরআনে বারবার আল্লাহ আমাদেরকে তাওয়াক্কুলের দাওয়াত দিয়েছেন। তিনি বলেন:
“যখন তুমি দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ কর, তখন আল্লাহর উপর ভরসা করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাওয়াক্কুলকারীদের ভালোবাসেন।” (সূরা আলে ইমরান, আয়াত ১৫৯)
এই আয়াতে আমি ভালোবাসার সুর শুনি—আল্লাহ নিজেই তাওয়াক্কুলকারীদের ভালোবাসেন! ভাবা যায়? কত বড় সম্মান এটি! যে বান্দা আল্লাহর উপর নির্ভর করে, আল্লাহ তাঁকে নিজের ভালোবাসার যোগ্য বানিয়ে নেন।
আমি যখন অসুস্থ হয়ে পড়েছি, আমি বলেছি—“হে আল্লাহ, তুমি শিফা দাও।” আমি যখন রিযিকের টানাটানিতে পড়েছি, বলেছি—“তুমি রিযিকদাতা।” আমি যখন দুশ্চিন্তায় ডুবে গেছি, তখন আমি তোমার নাম নিয়েই শান্তি পেয়েছি। সত্যিই, হে প্রভু, আমি যতবার ভরসা রেখেছি তোমার উপর, ততবারই দেখেছি, তুমি আমাকে নিরাশ করোনি।
একজন মুমিনের জীবন তাওয়াক্কুলের সুগন্ধে ভরে থাকে। সে জানে, সফলতা তার হাতে নয়—আল্লাহর হাতে। তাই সে কখনো অহংকার করে না, আবার ব্যর্থ হলেও হতাশ হয় না। এই ভারসাম্যই তাওয়াক্কুলের মর্ম। এটি শুধু আত্মাকে নয়, মনকেও প্রশান্ত করে।
আমার জীবনের অনেক মুহূর্তে আমি একা ছিলাম। আশেপাশে কেউ ছিল না, কথা বলারও কেউ ছিল না। কিন্তু আমি জানতাম, এক আসমানভরা শ্রোতা আছেন যিনি আমার নিঃশব্দ কথাও শুনছেন। যখন আমি চোখ বন্ধ করে তোমার নাম নিয়েছি, তখন মনে হয়েছে—পুরো দুনিয়া যেন আমার সঙ্গে দোয়ায় অংশ নিচ্ছে।
তাওয়াক্কুল মানুষকে সাহসী করে, নম্র করে, স্থির করে। কারণ সে জানে, কিছুই নিজের হাতে নেই, সবই আল্লাহর হাতে। যে এই বিশ্বাস অন্তরে স্থাপন করতে পারে, তার জীবনে কোনো অশান্তি থাকতে পারে না। সে প্রতিটি মুহূর্তে আল্লাহর কুদরত অনুভব করে—বাতাসে, বৃষ্টিতে, হৃদয়ে, জীবনে।
হে প্রভু, আমি ভরসা রেখেছি কেবল তোমার উপর। আমার জীবনের প্রতিটি সাফল্যের পেছনে তোমার দয়া, প্রতিটি ব্যর্থতার ভেতর তোমার শিক্ষা, প্রতিটি দুঃখের মাঝে তোমার রহমত অনুভব করি। আমি জানি, যতই আমি হারাই না কেন, তোমার উপর নির্ভর করলে আমি কিছুই হারাই না।
এই লেখাটি আমি লম্বা করতে চাইনি, কিন্তু তাওয়াক্কুলের আলো নিয়ে যখন কলম ধরলাম, তখন অন্তরের আবেগে থামতে পারলাম না। এজন্য বিশেষভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। তবে এই লেখাটিই আমার জীবনের সাক্ষ্য—যে প্রভুর উপর ভরসা করে, সে কখনো নিরাশ হয় না।
Comments
Post a Comment