আমাদের নবীর জীবনী কাহিনী ﷺ

 

আমাদের নবীর জীবনী কাহিনী ﷺ

মুহাম্মদ মুনীরুজ্জামান ত্বলহা দ্বীনের দ্বীপ্তি 
 

দুনিয়ার ইতিহাসে অসংখ্য মহাপুরুষ জন্মগ্রহণ করেছেন, কিন্তু কারো জীবনই এত আলোকোজ্জ্বল নয় যতটা আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ ﷺ এর জীবন। তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি আচরণ, প্রতিটি শিক্ষা মানবতার জন্য এক উজ্জ্বল বাতিঘর। তিনি ছিলেন আল্লাহর শেষ রাসূল, যিনি দুনিয়ার অন্ধকার দূর করে সত্য, ন্যায়, দয়া ও করুণার আলো জ্বালিয়েছেন। তাঁর জীবনী কেবল মুসলমানদের জন্য নয়, বরং সমগ্র মানবজাতির জন্য শিক্ষণীয়।

জন্ম ও শৈশব

আমাদের নবী ﷺ জন্মগ্রহণ করেন আরবের মর্যাদাপূর্ণ কুরাইশ গোত্রে, মক্কার পবিত্র নগরীতে, রবিউল আউয়াল মাসের বারো তারিখে, যা ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে "হাতির বছর" নামে পরিচিত। তখন মক্কা ছিল মূর্তিপূজা, কুসংস্কার ও জাহেলিয়াতের আঁধারে নিমজ্জিত। নবী ﷺ জন্মের আগেই তাঁর পিতা আবদুল্লাহ ইন্তেকাল করেন। ছয় বছর বয়সে মাতাও তাঁকে বিদায় জানান। এতিম জীবনের এই কষ্টকর শুরুই তাঁকে মানবতার প্রতি আরো দয়ালু ও মমতাময় করে তোলে।

ছোটবেলায় তিনি ছিলেন সত্যবাদী, লাজুক ও কোমল হৃদয়ের। চাচা আবু তালিবের তত্ত্বাবধানে তিনি বড় হতে থাকেন। অল্প বয়স থেকেই তিনি পশুচারণ ও ব্যবসায়ে অংশ নেন। সমাজ তাঁকে চিনত একজন বিশ্বস্ত ও সৎ তরুণ হিসেবে। তাই তাঁকে বলা হতো আল-আমীন—অর্থাৎ বিশ্বাসযোগ্য।

যৌবনের দীপ্তি

যৌবনে নবী ﷺ ছিলেন অসাধারণ চরিত্রবান। মক্কার যুবকেরা যখন নানা অসৎ কাজে নিমগ্ন থাকত, তিনি সেসব থেকে দূরে থাকতেন। সত্যবাদিতা, দায়িত্বশীলতা ও স্নিগ্ধ স্বভাব তাঁকে সমাজে বিশেষ মর্যাদা এনে দেয়। খদিজা (রা.) তাঁর সততা ও দক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে তাঁকে ব্যবসার দায়িত্ব দেন। পরে তাঁর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। এই বিবাহ নবী ﷺ এর জীবনে শান্তি, স্থিতি ও আধ্যাত্মিক সমৃদ্ধি এনে দেয়।

নবুওয়তের সূচনা

চল্লিশ বছর বয়সে নবী ﷺ হেরা গুহায় নির্জনে ইবাদত করতে শুরু করেন। এক রাতে জিবরাঈল (আ.) নাযিল হয়ে তাঁকে প্রথম ওহী প্রদান করেন: اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ — “পড়ো তোমার প্রতিপালকের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন।” এই মহ মুহূর্তেই তাঁর জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু হয়। তিনি মানবজাতিকে আল্লাহর একত্ববাদ, ন্যায়, করুণা ও আখিরাতের শিক্ষা দিতে থাকেন।

মক্কার দাওয়াত

নবুওয়তের প্রথম তেরো বছর মক্কায় তিনি অক্লান্তভাবে মানুষকে সত্যের পথে আহ্বান করেন। তিনি বলতেন: قولوا لا إله إلا الله تفلحوا — “বল, আল্লাহ ছাড়া আর কোনো উপাস্য নেই, তাহলেই সফল হবে।” কিন্তু মক্কার নেতারা তাঁকে ও তাঁর সাহাবীদের উপর ভয়াবহ নির্যাতন চালায়। কেউ ইসলাম গ্রহণ করলে তাকে সমাজচ্যুত করা হতো, নির্যাতন করা হতো এমনকি হত্যা করা হতো। তবুও নবী ﷺ ধৈর্য ধরে দাওয়াত চালিয়ে যান।

হিজরত ও মদিনার জীবন

নির্যাতনের সীমা অতিক্রম করলে আল্লাহর নির্দেশে নবী ﷺ ও তাঁর সাহাবীরা মদিনায় হিজরত করেন। এখানে তিনি প্রথম ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। মসজিদে নববী নির্মাণ করেন, মুসলিম-অমুসলিম সবার জন্য ন্যায়ের সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। মুহাজির ও আনসারের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব স্থাপন করে তিনি সমাজে ঐক্যের সুন্দর দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।

যুদ্ধ ও সংগ্রাম

ইসলাম রক্ষার জন্য বদর, উহুদ ও খন্দকসহ বহু যুদ্ধ সংঘটিত হয়। তবে নবী ﷺ কখনো অন্যায়ভাবে যুদ্ধ শুরু করেননি। তিনি সবসময় প্রতিরক্ষা ও শান্তির জন্য সংগ্রাম করেছেন। মক্কা বিজয়ের সময় তিনি তাঁর শত্রুদের সাধারণ ক্ষমা করে দিয়ে বলেছিলেন: اذهبوا فأنتم الطلقاء — “তোমরা মুক্ত, আজ তোমাদের বিরুদ্ধে কোনো দোষ নেই।” এমন ক্ষমাশীলতা মানব ইতিহাসে বিরল।

ব্যক্তিগত জীবন

নবী ﷺ ছিলেন আদর্শ স্বামী, দয়ালু পিতা ও কোমল হৃদয়ের বন্ধু। তিনি স্ত্রীদের সাথে ভালো ব্যবহার করতেন, সন্তানদের স্নেহ করতেন। তাঁর গৃহজীবন ছিল সহজ, পরিপূর্ণ দয়া ও ভালোবাসায় ভরা। তিনি কখনো কারো সঙ্গে কঠোর আচরণ করতেন না। এমনকি দাস-দাসীর সঙ্গেও তিনি অসাধারণ দয়া প্রদর্শন করতেন।

মানবতার জন্য শিক্ষণীয়

  • তিনি শিখিয়েছেন সত্যবাদিতা ও ন্যায়পরায়ণতার গুরুত্ব।
  • তিনি দেখিয়েছেন কিভাবে ধৈর্য ও তাওয়াক্কুল অবলম্বন করতে হয়।
  • তিনি শিখিয়েছেন মানুষের সাথে দয়া, ক্ষমা ও ভ্রাতৃত্বপূর্ণ আচরণ।
  • তিনি দেখিয়েছেন আল্লাহর প্রতি সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণই প্রকৃত মুক্তি।

শেষ জীবন ও ইন্তেকাল

নবী ﷺ শেষ হজ্জে বিদায়ের ভাষণ দেন, যেখানে তিনি মানবতার জন্য অনন্য দিকনির্দেশনা রেখে যান। তিনি বলেন: “আমি তোমাদের কাছে দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি; যদি তোমরা তা আঁকড়ে ধরো তবে কখনো পথভ্রষ্ট হবে না: আল্লাহর কিতাব ও আমার সুন্নাহ।” ৬৩ বছর বয়সে রবিউল আউয়াল মাসে তিনি ইন্তেকাল করেন। তাঁর মৃত্যুতে মদিনা নগরী শোকে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।

পরিশেষে,,

আমাদের নবী ﷺ এর জীবনকাহিনী হলো মানবতার সর্বোত্তম দিকনির্দেশনা। তাঁর জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত শিক্ষা, অনুপ্রেরণা ও আলো। আজকের অস্থির পৃথিবীতে শান্তি, ন্যায়, ভালোবাসা ও মানবিকতা প্রতিষ্ঠা করতে হলে আমাদের তাঁর জীবন থেকে শিক্ষা নিতে হবে। তাঁর সীরাত হলো এমন এক আয়না, যেখানে আমরা নিজেদের দুর্বলতা খুঁজে পেতে পারি এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির পথে এগিয়ে যেতে পারি। তাই সীরাত অধ্যয়ন করা কেবল ধর্মীয় দায়িত্ব নয়, বরং এটি মানবতার জন্য অপরিহার্য দিকনির্দেশ।

Comments

Popular posts from this blog

“দ্বীনের দীপ্তি: ইসলামের মূল শিক্ষা”

স্মৃতির প্রাঙ্গণ ও মাধুর্যের ঋণ

📘 প্রথম সাময়িক পরীক্ষার প্রস্তুতি